চার হাজার ৭০০ টাকার জন্য বন্ধুকে হত্যা, তিন হাজার টাকা ও স্মার্টফোনের জন্য বন্ধুকে হত্যা, প্রেমের জেরে বন্ধু হত্যা এবং মাদকের টাকার জন্য স্ত্রীকে হত্যা—গত মার্চ মাসে দিনাজপুরে এই চারটি ঘটনা আলোচিত। এসব ঘটনায় জড়িতরা নিহতদের বন্ধু এবং স্বজন। ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
আরেকটি বিষয় হলো এসব ঘটনায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা কিশোর এবং যুবক। অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছেন তারা। হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছেন এসব কিশোর ও যুবক।
পুলিশ জানিয়েছে, এসব ঘটনার মূলে রয়েছে মাদক, টাকা ও মোবাইল আসক্তি। পাশাপাশি রয়েছে অসম বন্ধুত্ব ও প্রেম। এসব ঘটনা প্রতিরোধে অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। সেইসঙ্গে সচেতন মানুষজন ও বিভিন্ন সংগঠনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে পুলিশ।
পুলিশ জানায়, গত ৩০ মার্চ দুপুরে জেলা শহরের হাউজিং মোড় এলাকা থেকে গৃহবধূ আরিফা বেগমের (২৭) লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় তার স্বামী বেলাল হোসেনকে (৩০) গ্রেফতার করে পুলিশ।
স্বজনদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে বেলাল মাদকাসক্ত। নেশার টাকার জন্য স্ত্রীকে মাঝেমধ্যে মারধর করতেন। ওই দিন মাদকের টাকার জন্য স্ত্রীকে শ্বাসরোধে হত্যা করে পালিয়ে যান। পরে অভিযান চালিয়ে বেলালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের পর হত্যার কথা স্বীকার করেন তিনি।
দিনাজপুর সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শেখ মোহাম্মদ জিন্নাহ আল মামুন বলেন, ‘বেলাল মাদকাসক্ত ছিলেন। মাদকের টাকার জন্য স্ত্রীকে হত্যা করার কথা স্বীকার করেছেন। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’
জিয়াউর রহমানকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার মাসুদ রানা
গত ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নের তাঁতীপাড়া গ্রামে খড়ের গাদার ভেতর থেকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা জিয়াউর রহমানের (২৯) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার পর জিয়াউর রহমানের বড় ভাই সাগর আলী কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার পর জিয়াউর রহমানের বন্ধু মাসুদ রানাকে (২৫) গ্রেফতার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে টাকার জন্য জিয়াউরকে হত্যার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেন মাসুদ।
এ ব্যাপারে জেলা পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, ‘জিয়াউর মাদক বিক্রি এবং বন্ধু মাসুদের সঙ্গে সেবন করতেন। মাসুদ বাকিকে জিয়াউরের কাছ থেকে মাদক কিনতেন। এতে চার হাজার ৭০০ টাকা বাকি ছিল। এ নিয়ে বিরোধ দেখা দেয়। ২৪ সেপ্টেম্বর বিকালে জিয়াউরকে হত্যা করে লাশ খড়ের গাদার ভেতর লুকিয়ে রাখেন।’
গত ১৪ মার্চ রাতে চিরিরবন্দর উপজেলার আলোকদিহি ইউনিয়নের গোশাহার এলাকায় মিরাজ ইসলাম (১৩) নামে এক শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়। তিন হাজার টাকা ও স্মার্টফোনের লোভে তাকে হত্যা করে তারই দুই বন্ধু (১৪) এবং (১৫)। গ্রেফতারের পর হত্যার কথা স্বীকার করেছে তারা।
চিরিরবন্দর থানার ওসি বজলুর রশিদ বলেন, ‘এক বছর আগে মিরাজ তার এক বন্ধুর কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ধার নেয়। টাকা ফেরত না দেওয়ায় অপর বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মিরাজকে হত্যা করে তারই বন্ধু। পরে মিরাজের স্মার্টফোন নিয়ে যায় তারা। মূলত টাকা ও মোবাইলের জন্য তাকে হত্যা করা হয়।’
গত ৬ মার্চ জেলা স্টেডিয়ামের গ্যালারির সিঁড়ির নিচ থেকে শাহরিন আলম বিপুলের (১৮) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় সদর উপজেলার শালকী এলাকার দেলোয়ার হোসেন (২০), ৬ নম্বর উপশহরের শাকিব শাহরিয়ার (২২), নিশ্চিতপুর এলাকার আশরাফুল হোসেন মিলন (১৮) এবং ৭ নম্বর উপশহর এলাকার আসিফ মাহমুদ হৃদয়কে (১৯) গ্রেফতার করা হয়।
কোতোয়ালি থানার ওসি তানভিরুল ইসলাম বলেন, ‘দেলোয়ারের সঙ্গে এক মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ওই মেয়ে দেলোয়ারের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। পরে দেলোয়ার ওই মেয়ের বান্ধবীকে পছন্দ করেন। কিন্তু ওই বান্ধবীর সঙ্গে বিপুলের প্রেম ছিল। বিষয়টি দেলোয়ার মেনে নিতে না পেরে বন্ধুদের নিয়ে বিপুলকে হত্যা করে লাশ গ্যালারির সিঁড়ির নিচে রেখে যান।’
পুলিশ জানায়, এসব ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনাগুলোর মূলে ছিল মাদক ও টাকা। পাশাপাশি মোবাইল, অসম বন্ধুত্ব ও প্রেম এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। মাদক, টাকা, মোবাইল ফোনের লোভে নানা অপরাধে জড়াচ্ছেন কিশোর ও যুবকরা।
এদিকে, গত এক মাসে জেলায় কয়েকটি চুরি-ছিনতাই ও মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে, তারাও কিশোর এবং যুবক।
গত ২৩ মার্চ টাকা ও মোবাইল ছিনতাইয়ের সময় আব্দুর রাজ্জাক (২২) এবং মেহেদী হাসানকে (২০) গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৪ মার্চ এক অটোবাইক চাললকে কুপিয়ে জখম করে ৮০০ টাকা ও অটোবাইক নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় সুমন ইসলাম (২৫), শামীম (৪০), শাহীন (৩২), শরিফুল ইসলাম (৩৪) ও সেলিমকে (৩০) গ্রেফতার করা হয়। এই দুটি ছাড়াও ছিনতাইয়ের ঘটনায় আরও কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, ‘গত মাসে জেলায় ঘটে যাওয়া সবগুলো ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন অপরাধ কিছুটা কমেছে। তবে হত্যাকাণ্ডের বিষয়গুলো আলাদা।’
তিনি বলেন, ‘বন্ধুদের মাধ্যমে তিনটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব বন্ধুত্ব ও প্রেম ছিল অসম। আরেকটি ঘটনা মাদক সংশ্লিষ্ট। মাদক, টাকা ও মোবাইল ফোনের লোভে এসব ঘটনা ঘটাচ্ছেন কিশোর এবং যুবকরা।’
অসম বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া জরুরি উল্লেখ করে পুলিশ সুপার বলেন, ‘মাদকের ভয়াবহতা রোধেও অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। সন্তানরা কার সঙ্গে মিশছে, কার সঙ্গে চলাফেরা করছে, সেটি দেখার দায়িত্ব পরিবারের। আমরা কিশোর ও যুবকদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছি। আমাদের পাশাপাশি অভিভাবক, শিক্ষক, সচেতন নাগরিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। কিশোর ও যুবকদের অপরাধ কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখতে কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজন আছে। সবাই সহযোগিতা করলে এসব অপরাধ কমে আসবে।’
এসএ